০৬ জানুয়ারি ২০২৫

Darjeeling Tea Industry Crisis

মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা, চা বাগানের পুনরুজ্জীবন বাণিজ্যিক পথে সম্ভব নয়

মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিং চা বাগানে অপরিচালিত ৩০% জমি চা ছাড়াও জমি পর্যটন, হোটেল ব্যবসা এবং ইকো-ট্যুরিজম ব্যবহারের অনুমতি দিতেই, CPI(M) মজদুর ইউনিয়নের সভাপতি, সামান পাথক এবং সংসদ সদস্য রাজু বিস্তা প্রতিবাদ জানায়I যদিও সরকারের বিশ্বাস, এই সিদ্ধান্ত চা বাগানগুলিকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করবেI

কেন টালমাটাল দার্জিলিং চা শিল্প?

  • ভারতীয় চা সমিতি জানিয়েছে যে, স্থবির মূল্য এবং উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধির ফলে চা শিল্প এক সংকটময় পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যতে এই ব্যবসার প্রতি আগ্রহ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
  • চায়ের দাম ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না। গত এক দশকে শ্রমিকদের মজুরি ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে চায়ের দাম মাত্র ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
  • ২০১৭ সালের ১০৪ দিনের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় দার্জিলিং চা বড় ধাক্কা খেয়েছিল। এই দীর্ঘ বন্ধের কারণে চা উৎপাদনও বন্ধ ছিল, ফলে বিদেশি ক্রেতারা নেপাল ও অন্যান্য দেশের চায়ের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হফলসবরুপ নেপালের চা ধীরে ধীরে বাজার দখল করতে শুরু করে
  • চা বাগানের ক্রমশ অবনতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে কীটপতঙ্গের বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র চা চাষিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং স্থবির রপ্তানি চা শিল্পকে এমন এক সংকটময় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।
  • ২০১৯ সালে রাজ্য সরকার অ-চা কার্যকলাপের অনুমতি দেওয়ার পর অনেক চা বাগান চা পর্যটনের দিকে ঝুঁকেছিল। তবে এই খাতও স্থায়ীভাবে লাভজনক হয়নি।
  • একজন চা পর্যটন ব্যবসায়ী জানান, "শুধুমাত্র কোভিড-পরবর্তী সময়ে পর্যটকদের ঢল নামায় কিছুটা লাভ হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে তেমন সাড়া নেই। শহরের কাছাকাছি অবস্থিত রিসর্টগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো ব্যবসা করলেও পাহাড়ি বাগানগুলো সেভাবে পর্যটনের সুবিধা পাচ্ছে না।"
  • গত ১৫ বছরে ভারতের চা উৎপাদন ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০০৮ সালে ৯৮১ মিলিয়ন কিলোগ্রাম থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১৩৬৬ মিলিয়ন কিলোগ্রামে পৌঁছেছে। ২০২৩ সালে উৎপাদন প্রায় ১৩৬৫ মিলিয়ন কিলোগ্রাম হতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছিল, যা খুবই সামান্য বৃদ্ধি। তবে, রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ সালের প্রথম সাত মাসে চা উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ২০.৮ শতাংশ হ্রাস পরিলক্ষিত হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেকটাই কম।

সরকারি সিদ্ধান্তে চরম ক্ষোভ

  • দার্জিলিং চা শিল্পে অচলাবস্থা এখনও চলছে। কিন্তু সরকারের বিকল্প সিদ্ধান্তে খুশি নয় চা চাষিরা।
  • দার্জিলিং চা শিল্পের একটি অংশ রাজ্য সরকারের চা বাগানগুলোর জমি বিকল্প কাজে ব্যবহারের অনুমতি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকাশ করেছে অসন্তোষ। অনেক পাহাড়ি চা বাগান মালিকদের মতে, চা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার দিকেই সরকারের জোর দেওয়া উচিত ছিল, বিকল্প ব্যবহারের দিকে নয়।
  • মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, চা বাগানের মোট জমির ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অনাবাদী বা পতিত জমিকে অ-চা কার্যকলাপে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে। আগে এই সীমা ছিল ১৫ শতাংশ। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চা শিল্পের অনেকেই।
  • এক সিনিয়র চা বাগান মালিক বলেন, "এই সিদ্ধান্ত মূলত শহরের কাছাকাছি থাকা কিছু নির্দিষ্ট চা বাগানেরই উপকারে আসবে। কিন্তু পাহাড়ি চা বাগানে পতিত জমি কোথায়?"
  • দার্জিলিং চা শিল্পে ৮৭টি চা বাগান রয়েছে, যার বেশিরভাগই শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। তাই, অনেক মালিকের মতেই, রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত মূল সমস্যার সমাধান তোঁ নয়ই বরং এতে সমস্যা আরও বাড়বে।
  • চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, জমির মালিকানা, এবং সামাজিক নিরাপত্তার দাবিতে শনিবার দার্জিলিংয়ের চৌরাস্তায় সংযুক্ত চা শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।
  • মূলত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টি ট্যুরিজমের জন্য চা বাগানের ৩০% জমি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ঘিরেই এই ক্ষোভ দানা বেঁধেছে।

তৃনমূল বিজেপির দ্বন্দ্বের কেন্দ্র এবার দার্জিলিং চা শিল্প

  • দার্জিলিং ও তরাই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চা শিল্পের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চা শ্রমিকদের নিয়ে রাজনৈতিক দলবাজিও কম হয় না! ভোট ব্যাংক হিসাবে চা শ্রমিকদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এরপর ভোট চলে গেলে যে কে সেই।
  • ভোটের সময় চা শ্রমিকদের জন্য প্রকল্প ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে সেগুলো কার্যকর হয় না।
  • দার্জিলিং ও ডুয়ার্সের চা বাগান এলাকায় বিজেপির শক্তিশালী ভোট ব্যাংক রয়েছে। একদিকে যেমন বিজেপি চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, জমির অধিকার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস চা শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষণা করলেও, চা শিল্পের মূল সমস্যার সমাধান হয়নি।
  • পশ্চিমবঙ্গের চা-বাগানের অব্যবহৃত জমির ৩০% শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক দানা বেঁধেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে যুক্তি দিলেও, বিরোধী শিবির বিশেষ করে বিজেপি নেতা ও দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্তা এর কড়া বিরোধিতা করেছেন।
  • দার্জিলিং এমপি রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে দেখা করে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্মারকলিপি জমা দেনI তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকেও বিষয়টি নিয়ে চিঠি দিয়েছেন।
  • রাজু বিস্তার বক্তব্য: "নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে ১,০০০ একর জমি ছিল, আর এখানে ১ লক্ষ একরের বেশি জমি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। চা-বাগান শ্রমিকদের অগ্রাহ্য করে যদি সরকার এই সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, তাহলে এর ভয়াবহ পরিণতির জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দায়ী থাকবেন।"
  • তিনি আরও বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোর করে এই আইন চাপিয়ে দিলে তার ফল ভালো হবে না। আমরা বড় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।"
  • সরকারের মতে, এই সিদ্ধান্ত চা শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। কিন্তু বিরোধী নেতা রাজু বিস্তারের মতে চা-বাগানের জমি আইনত শুধুমাত্র চা-চাষের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। টি-বোর্ডের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো কাজে এই জমি ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
  • তিনি বলেন, "সরকার যে ‘অব্যবহৃত জমি’র কথা বলছে, তা আসলে শ্রমিকদের বসবাসের ও জীবিকার অংশ। এই জমি কেড়ে নেওয়া হলে শ্রমিকরা বিপদে পড়বে।"
  • সরকার নিজেদের সবার্থে আসলে পর্জটনের কথা বলছে, শ্রমিকদের বিপদে ফেলে তারা নিজেদের সবার্থ চরিতার্থ করছে।
  • শ্রমিকদের সাথে কথা না বলে চায়ের জমি দিয়ে পুঁজিপতিদের হাতে সরকার তুলে দিতে পারে না।
  • রাজু বিস্তার দাবি, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো অধিকার নেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার, কারণ দার্জিলিং ঐতিহাসিকভাবে সিকিমের অংশ ছিল।"
  • পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০০-৪০০ টি চা বাগান আছে। বর্তমানে বেশীরভাগ চা বাগান অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের প্রথম চা বাগান হিরাছরার চা শ্রমিকরা বলেন, মজুরি দিচ্ছে না ঠিকঠাক এইভাবে তো চলে না! সরকার হস্তক্ষেপ করুক।
  • বাংলায় যখন চা শিল্প ও শ্রমিক সমস্যা এতো গুরুতর তখন সেই দিকেই সরকারের নজর দেওয়া বেশী কাম্য নয় কি?

.

ব্রডকাস্ট চ্যানেল

ডেইলি ডিজিটাল নিউজ পেপার